ইউক্রেন যুদ্ধ : বাংলাদেশের করণীয়
প্রকাশিত : 12:21 PM, 22 June 2022 Wednesday

বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক জোট ন্যাটো জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে চলবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তার দেশের মানুষকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। অপরদিকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সম্মেলন থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলো খালি হাতে ফিরেছে। সংস্থার নিয়ন্ত্রক ধনী দেশগুলো স্বল্পোন্নতদের কথায় কর্ণপাতও করেনি। এমনটি আগে হয়নি।
আগামী দিনে এ সংস্থার সম্মেলন হলেও এজেন্ডা পালটে যাবে। সামরিক দিক থেকে এ যুদ্ধে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সৈন্যরা লড়াই করলেও যুদ্ধটা অর্থনৈতিক বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। ফলে বদলে যাচ্ছে ইউরোপীয় আর্থসামজিক, মানবিক মূল্যবোধ, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর। আগামী দিনে চেয়ে পাওয়া বা খাওয়ার দিন শেষ। বাঁচতে চাইলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সতর্ক করেছেন। আগে বলেছেন, কৃচ্ছ্র সাধনের কথা। পরে বলেছেন অপরিকল্পিত ব্যয় বন্ধ করতে। এরপর সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরা, উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে প্রকল্প এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ খেয়াল করা, দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনা, কৃষিজমি রক্ষায় যত্রতত্র শিল্প স্থাপন করতে না দেওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করাসহ সর্বশেষ সিদ্ধান্ত রাত ৮টার পর সারা দেশে দোকানপাট-শপিংমল বন্ধ রাখা।
তিনি আঁচ করতে পেরেছেন ইউক্রেন-রাশিয়ার সর্বগ্রাসী যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী হতে পারে। কারণ যুদ্ধ শুধু রণাঙ্গনেই নয়, সর্বত্রই শুরু হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আগামী দিনে টিকে থাকার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতা। সময়োচিত সঠিক সিদ্ধান্তই একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। কৃষিনির্ভর বিপুল জনসংখ্যার এ দেশে উৎপাদনের প্রধান খাত কৃষি। কৃষি খাত বলতে ধান, পাট, গম, ভুট্টা থেকে শুরু করে মৎস্য, পশুপালন, শাকসবজি, ফলমূল সবকিছু বোঝায়। এর জন্য কৃষিজমি দরকার। কিন্তু দিনকে দিন সারা দেশে কৃষিজমি কমতে শুরু করেছে।
শিল্পের নামে জমি আটকে রাখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ তাতে উৎপাদন বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঠিক বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন সংসদ-সদস্যরা। তারা চাইলে এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে নতুন আইন প্রণয়নও করতে পারেন। তারা জোরালোভাবে প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকলে দেশ ও জাতির কল্যাণ হবে। রাজনীতি শক্তি পাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি দেশের জন্য কাজ করার শক্তি পান দেশবাসীর সমর্থন থেকে। সংসদ সদস্যরাও পাবেন। তারা সক্রিয় হলে তাদের দলে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়বে। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য আমলাতন্ত্রের কূটচালের ওপর নির্ভর করতে হবে না। জনসমর্থনে দেশবিরোধী সব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ধুলোয় মিশে যাবে। সংসদ-সদস্যরা যদি তার এলাকার কৃষিজমি রক্ষার কথা চিন্তা করেন, পরিবেশ বাঁচান, তাহলে কারও হিম্মত হবে না লুটপাটের বিস্তার ঘটানোর। জনকল্যাণে শুধু সরকার নয়, জনপ্রতিনিধিরাও দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করতে পারেন। সাধারণ মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে। কারণ, জনপ্রতিনিধিদের নিয়েই গণতান্ত্রিক সরকার হয়। সংসদ সদস্যদের বড় শক্তি দলের নেতাকর্মী। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়নে তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। দেশের প্রতিটি গ্রামে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছেন। কারা বাউন্ডারি শিল্পের এজেন্ট বা কারা কৃষিজমি কিনে লুটপাট করে, নেতাকর্মীরা সবই জানেন। তারা রুখে দাঁড়ালে প্রতিটি ঘটনা সরকার জানতে পারবে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারেন। যদি তারা একটু নির্মোহ হন। এমপি, মন্ত্রী, নেতাকর্মী কেউ কিছু না করলেও স্থানীয় সংবাদকর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে পারেন। তারা সরকার তথা দেশবাসীকে অবহিত করতে পারেন। এ অবহিত করাটাই সংবাদকর্মীদের অন্যতম পেশাগত দায়িত্ব। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে প্রশাসনকে। প্রশাসন সে দায়িত্ব পালন না করলে সংবাদকর্মীরা সেটাও জাতিকে অবহিত করার অধিকার রাখেন। অবশ্য যদি দেশ ও মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আছে বলে তারা মনে করেন। দেশের ব্যাংকগুলোতে জনগণের টাকা থাকে। জনগণের টাকায় ব্যাংক ব্যবসা করে। ব্যাংকের লকার থেকে টাকা আকাশে উড়ে যায় না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা বেরোয়। এগুলো জনগণ করে না, করে ব্যাংকের লোকেরাই। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি লুটের অংশীদার না হয়ে থাকে অথবা জেনেশুনে লখিন্দরের উপাখ্যানের মতো ‘ছিদ্র’ না রাখে তবে কারও সাধ্য নেই ব্যাংকের টাকা লুট করে নিয়ে যায়। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায় বিভিন্ন পন্থায়। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে শুধু রিপোর্ট হয়, টাকা উদ্ধার হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত অনেক লম্বা। তারা চাইলে সবই করতে পারে। ব্যাংকগুলো প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়নে যদি ইমানদারির সঙ্গে কাজ করে, তাহলে জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান শ্রেণি ব্যবসায়ী সমাজ। দেশ ও জাতির কল্যাণে তারা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। একটি দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি দুটি বিষয়ের একটি হচ্ছে ‘দেশপ্রেমিক আমলাতন্ত্র’, অপরটি ‘দেশপ্রেমিক পুঁজি’। এ দুই শ্রেণির মধ্যে দেশপ্রেম থাকলে কারও সাধ্য নেই লুটপাট করে। ব্যবসায়ীরা বড় বিনিয়োগকারী। তাদের দল আছে। তাদের অনেক ক্ষমতা। আর সে কারণেই তারা যখন যা চায়, সরকারের কাছ থেকে তা আদায় করে নিতে পারে। তেলের দাম, জলের দাম-সবকিছুতেই তারা তাদের মতো করে মুনাফা নিশ্চিত করে নেয়। একশ্রেণির মানুষের বেশুমার লালসার শিকার দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আক্ষরিক অর্থে কোনো দল নেই। তবে তাদের আশা-ভরসার একমাত্র জায়গার নাম ‘সরকার’। সত্যিকার অর্থে সরকার ছাড়া দেশের নিম্ন, নিম্ন-মধ্য ও মধ্যবিত্তের মানুষের কোনো দল বা সংগঠন নেই। এর বাইরে কিছু লোক আছে, যারা এ তিন শ্রেণির মানুষ নিয়ে ভিন্নমাত্রায় ধান্ধা করে। বিদেশিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেশের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের স্বার্থের কথা বলে নিজেদের আখের গোছায়। এরা এনজিও। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মতো। বিভিন্ন বিষয়ে সারাক্ষণ সরকারের সমালোচনায় মুখর থেকে বিদেশিদের স্বার্থ হাসিলের দরকষাকষি করার সুযোগ করে দেয়। তাদেরও দল আছে। সময়ে সময়ে সবাই এক সুরে কথা কয়। শুধু কথা কইতে পারে না সাধারণ মানুষ। তারা শুধু খেয়ে না খেয়ে ‘সামলে’ নেওয়ার নিরন্তর লড়াই করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির আলামত দেখা যাচ্ছে। ইউরোপ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে শরণার্থী কী জিনিস। তাদের বাজারে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি। বেকারত্ব ঘরে ঘরে। ফলে দীর্ঘদিনের সুবিধাভোগী ইউরোপীয় বিলাসী সমাজ সবকিছু বাদ দিয়ে নিজেদের কথা ভাবতে শুরু করেছে। ডব্লিউটিও সম্মেলন এর সাক্ষী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতেও। রেমিট্যান্সও কমে আসতে শুরু করেছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বহু প্রবাসী কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যও বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। সুতরাং এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। কর্মসংস্থানের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি খাত সবচেয়ে বড় সেক্টর। এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। কৃষিজমি রক্ষা করে কৃষিকে আরও আধুনিক করা হলে দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ পেশা হিসাবে কৃষিকাজে আগ্রহী হবে। কৃষিপণ্যের ভালো দাম নিশ্চিত করা হলে উৎপাদন দুই-তিনগুণ বেড়ে যাবে। যারা বাজারমূল্যের কথা বলে প্রতিনিয়ত গলা ফাটায়, সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে, তাদের গায়ে দ্রব্যমূল্যের আঁচ তেমন একটা লাগে না। কারণ তারাও বেনিফিশিয়ারি। বাজারে যায় ঘুসের টাকার বান্ডেল নিয়ে। গাড়ি ভরে জিনিস কিনে বেশুমার মুনাফার টাকা দিয়ে। শুধু ভোগান্তির শিকার হয় নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত। তাই দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে বাজার লুটেরাদের দমনে সরকারকে সার্বক্ষণিক তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান করে কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যাবে না। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বহু নজির আছে-দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় একশ্রেণির লোক বেশুমার অর্থসম্পদের মালিক হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক লুটেরা চক্রের লুটের সম্পদ রক্ষার নিরাপদ রক্ষক ‘সুইস ব্যাংক’। গত ১৫ জুন ওই ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমানো টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত এক বছরেই জমা হয়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এ হিসাব শুধু নগদে জমানো টাকার। এর বাইরে সোনাদানা, হীরা, মণি-মুক্তার হিসাব আলাদা। গত দুই বছর দেশ ছিল করোনায় আক্রান্ত। ব্যবসাবাণিজ্য, জীবন-জীবিকা সবকিছু প্রায় অচল ছিল। তারপরও এত বিপুল পরিমাণ টাকা সুইস ব্যাংকে গেল কীভাবে। কারা, কোথা থেকে কীভাবে এত টাকা পাচার করল-এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কারণ, সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রাখেন, তাদের নাম কখনো প্রকাশ করা হয় না। শুধু দেশের পরিচিতি জানা যায়। এরা মানুষের পকেট কাটে, বাজার লুটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ভোগ করতে পারে না। বাজার লুট রোধ করতে পারলে চরম সংকটেও মানুষের জীবন-জীবিকা সচল থাকবে। হাপিত্যেশ করবে শুধু বেনিফিশিয়ারি শ্রেণির লোকেরা। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষের মধ্যে এ উপলব্ধি থাকলে দেশ ও সমাজে স্থিতিশীলতা থাকবে। দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্থিতিশীলতা। সে কারণেই এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও দূরদর্শিতার ফসল। বাস্তবায়নের দায় দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। কারণ দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, স্বপ্ন থাকবে। মোল্লা জালাল : সিনিয়র সাংবাদিক, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক গণঅধিকার'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyganoadhikar@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
দৈনিক গণঅধিকার'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।